ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ভাগ্যরজনী শবে বরাত ; ফজীলত ও আমল

005601sompa-1আতিকুর রহমান মানিক :::

আরবী দিনপঞ্জী অনুসারে চান্দ্রমাস শাবানের ১৪ তারিখ আগামী ২২ মে।  রবিবার এ দিনে ‘পবিত্র শবে বরাত’। আরবী মাস হিসেবে ১৪ ই শা‘বানের দিবাগত রাত লাইলাতুল বারাআত বা শবে বারাআত নামে অভিহিত। এই পবিত্র রাতে নিহিত রয়েছে বহু তাৎপর্য, ফজীলত ও বরকত। অন্যদিকে মাহে শা‘বান, রমজানের পূর্বের মাস হওয়ার কারনে মূলত: এটি মাহে রমজানের সাধনা ও অধ্যাবাসায়ের পূর্ব প্রস্তুতির মাস। তাই তো রাসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন-শাবান আমার মাস , আর রমজান মহান আল্লাহর মাস।
রাসূল স. আরো বলেন: “তোমরা রমজানের জন্য শা‘বান মাসের চাঁদের সঠিক হিসাব রাখ। কারন, শা‘বানের হিসাব নির্ভূল হলে রমজানের চাঁদের হিসাব নিয়ে মতভেদ হবেনা।” (মিশকাত-১/১১৫)।
মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে:রাসূল স. কয়েকদিন ব্যতীত পূর্ণ শা’বান মাসের রোযা রাখতেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, অন্যান্ন মাসের তুলনায় শা’বান মাসের রোযা রাসূল স. এর নিকট অধিক প্রিয় ছিল।
শাবান মাসের ১৫তম রাত্রি বা শবে বারাআত সম্পর্কে রাসূল স. ইরশাদ করেন: “তোমরা শবে বারাআতের রজনীতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করবে এবং দিনের বেলা রোযা রাখবে। (মিশকাত)
“লাইলাতুল বারাআত” শব্দের অর্থ হল: গুনাহ থেকে মুক্তির রজনী। বস্তুতঃএই রজনীতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে গুনাহগার বান্দাদের গুনাহ মাফের উত্তম সুযোগ প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রিয়নবী স. ইরশাদ করেন: তোমাদের সামনে যখন শা‘বানের ১৫তম রজনী উপস্তিত হয় (অর্থাৎ শবে বারাআতের আগমন হয়) তখন তোমরা সে রাত্রটি জাগ্রত থেকে কাটাও, নামায পড়, কুরআন পড়। আর দিনের বেলা রোজা রাখ। কারন, এ দিনের (১৪ শা‘বানের) সূর্যাস্তের পরক্ষণেই আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে ফজর পর্যন্ত নূরের তাজাল্লীর বিচ্ছুরণ ঘটান এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় -এমন কোন গুনাহগার বা নাফরমান ব্যক্তি আছে কি -যে আমার সমীপে ক্ষামা প্রার্থনা করবে ? আমি তার গুনাহ মাফ করে দিব। কোন দারিদ্র্যক্লিষ্ট আছে কি যে, কষ্ট মেটানোর জন্য আমার নিকট দুআ করবে? আমি তার জন্য আমার রিযিকের ভান্ডার উম্মুক্ত করে দিব। কোন বিপদগ্রস্ত আছে কি- যে আমার নিকট বিপদ থেকে মুক্তি প্রার্থনা করবে? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দিব। রাসূল স. বলেন: “সারারাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সূর্য উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এরুপ ঘোষণা দেয়া হয়ে থাকে এবং বান্দাদের উপর অজস্র ধারায় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকে”। (ইবনে মাজাহ-১৫৫)
হযরত আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন -একদা রাসূল স. আমাকে সম্ভোধন করে বললেন: তুমি কি জান এ রাত্রে (শবে বারাআত) কি রয়েছে ? আমি বললাম – ইয়া রাসুলাল্লাহ স. দয়া করে একটু বলুন – এ রাতে কি রয়েছে ? রাসূল স. বললেন: আগামী বৎসর যত আদম সন্তান এই পৃথিবীর বুকে জন্ম নিবে এবং যারা মৃত্যুবরণ করবে, এ রাতে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে এ রাতে বান্দাদের আমলনামা আল্লাহর কাছে পেশ করা হয় এবং তাদের রিযিক অবতীর্ণ করা হয়। (মিশকাত-১/১১৫)
হযরত আয়শা (রাঃ) আরো বলেন: এক রাতে আমি নবীজীকে (স.) তাঁর স্থানে না পেয়ে তাঁর খুঁজে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে নবীজীকে (স.) জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে দেখি -তিনি আকাশ পানে মাথা উত্তোলন করে দু‘আ করছেন। রাসূল স. তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন: হে আয়শা (রাঃ) আমার নিকট হযরত জিবরাঈল আঃ এসেছিলেন। তিনি আমাকে বলে গেছেন: আজ অর্ধ শা‘বনের রজনী। আজ মহান আল্লাহ এত অধিক পরিমাণ লোকদেরে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন-‘কালব’ গোত্রের বকরীগুলোর যত পশম রয়েছে সে পরিমাণ। কিন্তু তা সত্তেও এমন কিছু দুর্ভাগা ব্যক্তি বা লোক রয়েছে,যারা এই পবিত্র রজনীতেও ক্ষমা লাভ থেকে বঞ্চিত হবে। তারা হল:-
১. আল্লাহর সাথে শিরক স্থাপনকারী।
২. হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী।
৩. অন্যায়ভাবে ট্যাক্স আদায়কারী।
৪. পিতা-মাতার নাফরমানীকারী।
৫. অহংকার বশত: পায়ের নিচে লুঙ্গি ও পায়জামা পরিধানকারী।
৬. যাদুকর ও ভাগ্য গণনাকারী। (মিশকাত-১/১১৫)
হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল স. ইরশাদ করেন: “শবে বারাআতে মালাকুল মাউতের কাছে একটি তালিকা দেয়া হয়। তাতে পরবর্তী বৎসরে যাদের মৃত্যু হবে, তাদের নাম লেখা থাকে। তালিকার সঙ্গে ঐ সকল লোকদের জান কবজ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। তালিকাভুক্ত লোকদের কেউ কেউ বৃক্ষ রোপন করছে, আর কেউ বিয়ে শাদী করে ঘর সংসারের যাত্রা করছে, কেউ বা ঘর-বাড়ি তৈরীর কাজে ব্যস্ত রয়েছে। অথচ তাদের নাম মৃত্যুর তালিকায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
রাসূল স. এর অজস্র হাদীসে এ শবে বারাআতের বহু ফজীলত ও তাৎপর্যের কথা জানা যায়। তা একত্রীকরণ করে এ মহিমান্বিত রাত সম্পর্কে নিম্ম বর্ণিত বিষয়াদি পাওয়া যায়:
১. এ রজনীতে মহান আল্লাহর দরবারে মানুষের আমলসমূহ পেশ করা হয়।
২. এ রজনীতে মহান আল্লাহ মুমিন বান্দাদের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ বা অনুকম্পা বর্ষণ করেন এবং তাদের গুনাহ মাফ করেন।
৩. শবে বারাআতের এ পূণ্যময় রজনীতেই পরবর্তী এক বৎসরের মৃত্যুবরণকারীদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
৪. এ রজনীতেই পরবর্তী এক বৎসরের রিযিক নির্ধারণ করা হয়।
৫. এ রজনীতেই মহান আল্লাহ সূর্যাস্তের পর থেকে পৃথিবীর আকাশে তাশরীফ আনেন এবং ফজর অবধি নিজ রহমতের কৃপা বিতরণ করতে থাকেন।
৬. এ রজনীতে বিশেষ কিছু অপরাধীদের ছাড়া নেক আমলে মগ্ন বাকী সকল অপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।
৭. এ রজনীতে মহান আল্লাহ নিজ বান্দাদের ক্ষমা ও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান প্রার্থনার জন্য আহবান করতে থাকেন এবং যারা যা প্রার্থনা করে, তাদেরকে তা দান করা হয়।
এ রাতে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। সম্পূর্ণ রাত্র জাগ্রত থেকে যে কোন ইবাদতে লিপ্ত থাকা যেতে পারে।
আর এ ধরনের রাতের ইবাদত ব্যক্তিগত পর্যায়ে কর বাঞ্ছনীয়। সম্মিলিতভাবে বা বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে এ ধরনের নফল ইবাদত-বন্দেগীকে শরীয়ত পছন্দ করে না। তাই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ভাবে নিজ নিজ গৃহের অভ্যন্তরে সংগোপনে এ রাতে ইবাদত-বন্দেগীতে আমাদের লিপ্ত থাকা কর্তব্য। আর মনে রাখতে হবে -শবে বারাআতে হালুয়া-রুটি বন্টনের কোন নিয়ম শরীয়তে নেই। এ ছাড়াও এ রাতে অধিক আলোকসজ্জা বা জাঁকজমক আয়োজন করা, পটকা ফুটানো, মোমবাতির বহর জ্বালানো ইত্যাদি গর্হিত কাজ। এ সকল অযাচিত কাজ থেকে মুসলমানদের দূরে থাকা একান্ত কর্তব্য।  আল্লাহ সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আসুন, চলমান দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহান এ রাতে আল্লাহর কাছে সবাই প্রার্থনা করি।

পাঠকের মতামত: